রাজ ভাইয়ের সৈনিক


  চট্টগ্রাম নয়, আশপাশের জেলায়ও তাঁর সমান দাপট। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটি তাঁর ইশারা ছাড়া হয়নি। বিভিন্ন কলেজ, ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে তাঁর আশ্রয়–প্রশ্রয়ে দাপিয়ে বেড়ায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। ক্ষমতার দাপটে নিজেও বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা–বাণিজ্যে ডালপালা মেলেছেন।

তিনি হলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। বলা হয়, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী তাঁর শিষ্য। ২০১৫ সালে মেয়র পদে নাছিরের ‘একতরফা’ নির্বাচন সফল করতে এই শিষ্য চট্টগ্রামে মাস্তান পাঠিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন


বিতর্কিত ভোটে মেয়র এবং অনিয়ম

২০১৫ সালে তৎকালীন মেয়র মনজুর আলমকে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে হারিয়ে প্রথমবার মেয়রের চেয়ারে বসেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। ফেনীতে নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার ও ভোট চুরির জন্য দলে দলে সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিলেন। ফলে দুপুর ১২টার মধ্যে মনজুর আলম নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

পাঁচ বছর মেয়র থাকাকালে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে নাছিরের বিরুদ্ধে। এ কারণে ২০২০ সালে দ্বিতীয়বার আর মনোনয়ন পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। মেয়র থাকাকালে আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের এক প্রকৌশলীকে নগর ভবনে থাপ্পড় মারার অভিযোগ ওঠে। পোর্ট কানেকটিং (পিসি) সড়ক সম্প্রসারণের একটি জায়গা নিয়ে সিটি করপোরেশন ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে।

কাজ শেষ করার আগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩৩ কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগও ছিল মেয়রের বিরুদ্ধে। ‘টাকা নেই’ অজুহাতে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন ঠিকাদার। ‘দরদ’ দেখিয়ে ঠিকাদারকে অন্য প্রকল্প থেকে আট কোটি টাকা দিয়ে দেয় সিটি করপোরেশন। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের এ সুবিধা দেওয়া হয়। টাকা নিয়ে মাঝপথে কাজ ফেলে চলে গেছেন ঠিকাদারেরা। প্রকল্প দুটি হচ্ছে পোর্ট কানেকটিং (পিসি) সড়কের উন্নয়ন এবং মহেশ খালের পাশে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ।

৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের দুটি অংশের কাজ পেয়েছিল মেসার্স রানা বিল্ডার্স ও মেসার্স রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহম্মদ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প কাজের যাবতীয় কাজ করত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ছালেহ আহম্মদ’। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পীরযাত্রাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকির হোসেন।

এই কাজের জন্য ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের কুমিল্লা শাখা থেকে ঋণ নেয় দুটি প্রতিষ্ঠান। শর্ত ছিল প্রতিষ্ঠান দুটির প্রাপ্য টাকার চেক ঠিকাদারদের পরিবর্তে ব্যাংকের প্রতিনিধিকে দেওয়ার; কিন্তু সিটি করপোরেশন নিজেই এই শর্ত ভঙ্গ করে ২৫ কোটি টাকার ১৪টি চেক সরাসরি ঠিকাদারকে তুলে দিয়েছে।

স্বেচ্ছাচারিতা

২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। একই কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর থেকে দলের একক নিয়ন্ত্রণ যায় নাছিরের হাতে। তখন মহিউদ্দিনপন্থীদের বিপরীতে দলে নিজের বলয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ নিয়ে বিরোধ চাঙা হয়ে ওঠে। সব৴শেষ এ বছরের ২০ জুন থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বর্ধিত সভায় যুগ্ম সম্পাদক ও সদ্য বিদায়ী মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে প্রকাশ্যে বিতণ্ডায় জড়ান নাছির।

ওই সময় রেজাউল করিম অভিযোগ করেছিলেন, দলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নাছির নিজের ইচ্ছেমতো স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে নাছির নগরের ওয়ার্ড, থানা ও ইউনিট কমিটি গঠন করেছেন। এসব কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।

চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আ জ ম নাছির উদ্দীন এক যুগের বেশি সময় নেতৃত্ব দেন। ২০১১ সালে তিনি প্রথম তখনকার সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমানকে হারিয়ে কর্তৃত্ব নেন। এরপর আরও তিন দফায় একই পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ঝামেলা এড়াতে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হননি।

চট্টগ্রাম কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির পদ নিতে জালিয়াতিতে অংশ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে নাছিরের বিরুদ্ধে। পরপর তিনবার এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। এরপর ওই পদে তাঁর বড় ভাই সাইফুদ্দিনকে সভাপতি করা হয়। প্রায় সাড়ে চার হাজার সদস্যের এই সমিতিতে থাকাকালে এলাকার জায়গা বেচাকেনা, অংকুর সোসাইটি স্কুলে ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আ জ ম নাছির চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সভাপতি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হিসেবেও রয়েছেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তিনি পদ ছাড়েননি।

ছাত্র–জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর আ জ ম নাছির উদ্দীন আত্মগোপনে চলে যান। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি।

সব সময় ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা, তাঁর অনুসারী ছাত্রদের মারামারি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো নাছির উদ্দীনের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে ছিল।
সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী

নাছিরের রাজনীতিতে উত্থান

আশির দশকের শুরুতে আ জ ম নাছির উদ্দীন আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হন। একই সময়ে নগর ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। একসময় তিনি নগরের ছাত্ররাজনীতিতে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর ধীরে ধীরে তা আওয়ামী রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেন।

নাছির উদ্দীন পরপর দুবার নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। নভেম্বর ২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। সেই কমিটি এখনো বহাল রয়েছে।

আ জ ম নাছির উদ্দীনের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সব সময় ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা, তাঁর অনুসারী ছাত্রদের মারামারি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো নাছির উদ্দীনের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে ছিল। ছাত্রদের সুনাগরিক ও সুরাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে না তুলে তাঁদের দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার দায় এড়াতে পারেন না তিনি। এ কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্রদের পড়ালেখার পরিবেশ।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form